কম খরচে অধিক উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাকে সামনে রেখে ভেনামি যুগে প্রবেশের অপেক্ষায় বাংলাদেশের চিংড়ি চাষি ও রপ্তানিকারকরা। চলতি বছরে দেশে প্রথম পরীক্ষামূলক ভেনামি (হোয়াইট লেগ) প্রজাতির চিংড়ি চাষে সাফল্য পাওয়ায় এ আশা দেখছেন তাঁরা।
বাণিজ্যিক চাষে অনুমতি মিললে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ চার-পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনে সক্ষম হবে। খুলনায় প্রথম পরীক্ষামূলক ভেনামি চাষ এলাকা পরিদর্শন করে চাষি ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী হিমায়িত চিংড়ি খাত। একসময়ে এই খাতটি পোশাক খাতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল, কিন্তু রপ্তানি চাহিদা কমায় বর্তমানে সপ্তম স্থানে নেমে এসেছে। চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজার দখল করে নিয়েছে ভেনামি, ফলে সুবিধা করছে পারছে না দেশের বাগদা (ব্ল্যাক টাইগার) ও গলদা। মৎস্য অধিদপ্তর এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৬৩৫ মেট্রিক টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে দেশের আয় ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৩৬ মেট্রিক টন রপ্তানি করে আয় ৩৩৩ মিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আয় এসেছে ৩২৯ মিলিয়ন ডলার। গত এক দশকেই ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমেছে।
এ অবস্থায় আধা নিবিড় (সেমি ইনসেনটিভ) পদ্ধতির ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষ রপ্তানিকারক ও চাষিদের নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। খুলনায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক চাষে চার একর জমিতে (১.৬ হেক্টর) এ প্রজাতির চিংড়ি চাষে ১৪ হাজার কেজির মতো উৎপাদন হয়েছে। হেক্টরপ্রতি এ উৎপাদন ১০ টন, যা অদূর ভবিষ্যতে ১৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হতে পারে।
ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি রোগ সহনীয়, উচ্চ ফলনশীল এবং দামে সস্তা হওয়ায় বিশ্ববাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয়নি। বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন ও বাণিজ্যের পরিমাণ ৭৭ শতাংশ। এশিয়ার চিংড়ি উৎপাদনকারী ১৫ দেশের মধ্যে ১৪টি দেশ ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু করেছে। প্রতিযোগী দেশ যেমন ভারত ৬.৫ লাখ মেট্রিক টন, ভিয়েতনাম চার লাখ মেট্রিক টন এবং থাইল্যান্ড ৩.৫ লাখ মেট্রিক মেট্রি টন ভেনামি চিংড়ি প্রতিবছর রপ্তানি করছে। এসব দেশও আগে বাংলাদেশের মতো বাগদা উৎপাদন করেছে। এখন বাগদার পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছে, কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বিপুল চাহিদার এ বাজার ধরতে পারছেন না।
২০১৯ সালে খুলনা ও কক্সবাজার এলাকায় পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ি চাষ ও পিএল উৎপাদনের জন্য হ্যাচারি ও স্থান নির্বাচন, উদ্যোক্তা নির্বাচন, ভেনামি চিংড়ি চাষ পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও প্রতিবেদন প্রদানের জন্য গঠিত উপকমিটি প্রাপ্ত আবেদনের আলোকে খুলনা অঞ্চলে বিএফআরআইয়ের লোনা পানি কেন্দ্র, পাইকগাছার উদ্যোক্তা হিসেবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলন (পার্টনার এমইউসি ফুডস লিমিটেড) এবং কক্সবাজারে গোল্ডেন একুয়া শ্রিম্প হ্যাচারি লিমিটেডকে প্রাথমিক কাজের জন্য নির্বাচন করে। পরবর্তী সময়ে কক্সবাজারে অ্যাগ্রো বিজনেস এন্টারপ্রাইজকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
খুলনা এলাকায় নির্বাচিত উদ্যোক্তা সুশীলন পাইকগাছায় নির্বাচিত ছয়টি পুকুরে চলতি বছরের ৩১ মার্চ ভেনামির পিএল (রেণু) অবমুক্ত করে। ১ জুলাই থেকে এসব পুকুরের চিংড়ি আহরণ করা হয়।
প্রকল্পের সমন্বয়ক ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার বলেন, ‘হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে এই প্রজাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পরীক্ষামূলক চাষে আমরা হেক্টরপ্রতি প্রায় ১০ টন পেয়েছি। এ প্রজাতির চিংড়ি রেণুর মৃত্যুহার কম, উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়াতে সক্ষম। ফলে ভেনামিতে চাষিরা লাভবান হবেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা থাইল্যান্ড থেকে রেণু (পিএল) এনেছি। হ্যাচারি ও পুকুরের লবণাক্ততার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য ছিল, তার পরও টিকে থাকার হার ৮৮ শতাংশ। এবারের রেকর্ড ৪০-৫৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও ভেনামির উৎপাদনের প্রভাব পড়েনি। বাণিজ্যিক চাষে অনুমোদন পেলে অর্থনীতিকে নতুন আশার সঞ্চার হবে।’
জাতীয় চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ রফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের চিংড়ি চাষিদের অবস্থা ভালো নেই। এখন বৈদেশিক বাজারে ভেনামির চাহিদা বেশি। ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষ আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতি প্রয়োজন। একই সঙ্গে অভিজ্ঞ চাষিদের দিতে হবে সরকারি ঋণসুবিধা।’
চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রান্তি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হাসান পান্না বলেন, ‘আমাদের দেশে দুই সহস্রাধিক পুকুর রয়েছে, যাতে আমরা আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করতে পারব। সরকারি অনুমোদন পেলে স্থানীয়ভাবে হ্যাচারি রেণু উৎপাদন সম্ভব হবে। এতে অনেক খরচ যেমন কমবে, তেমনি চাষি লাভবান হবেন। এই খাতকে বাঁচাতে হলে ভেনামির বিকল্প নেই।’
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম হুমায়ূন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের অ্যাসোসিয়েশন দীর্ঘদিন ভেনামি চাষ নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে এ প্রজাতি চাষে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই চিংড়ি উৎপাদন খরচ কম। যেখানে এক কেজি বাগদা উৎপাদন খরচ ৫০০-৬০০ টাকা, সেখানে ভেনামি উৎপাদন হবে ২৬০-২৮০ টাকায়।’
ভেনামি চিংড়ি চাষে সফলতা পাওয়া রপ্তানিকারক এমইউসি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, ‘মাত্র এক বছরের জন্য জমি পেয়ে নতুন প্রজাতির চিংড়ি চাষ ছিল চ্যালেঞ্জিং। পুকুর তৈরি, আধাকিলোমিটার তার টেনে বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রদান, অবকাঠামো নির্মাণেই অধিক অর্থ ব্যয় হয়েছে। ফলে পুকুরগুলোতে কমপক্ষে তিন বছর চিংড়ি চাষের সুযোগ ও সরকারি সহযোগীতা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করতে হলে ভেনামি প্রয়োজন। বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদন পেলে চাষি ও রপ্তানিকারকরা লাভবান হবেন। আমরা এখন ভেনামির বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছি।’ উৎপাদিত ভেনামি রপ্তানি প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম উৎপাদিত ভেনামি এখন রপ্তানির অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে অনেক দূর এগিয়েছি। আশা করি, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে দ্রুত পাঠাতে পারব।’
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ