মরিয়ম চম্পা
কোভিড-১৯ এর কারণে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলাকালীন লকডাউনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘরে আছে শিশুরা। এতে তাদের শরীর ও মনে কি ধরণের প্রভাব পড়ছে। এটা জানতে কথা হয় শহর ও গ্রামে থাকা একাধিক শিশুর সঙ্গে। লকডাউন ও করোনা ভাইরাস বলতে তারা কি বোঝে এমন প্রশ্নের জবাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন মতামত জানিয়েছে। আশফিউর রাইহান আল-রাজী। বয়স ৭ বছর। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকে যাত্রাবাড়ী। লক্ষীবাজারে অবস্থিত সেন্ট গ্রেগরি স্কুল এন্ড কলেজে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
রাজী জানায়, লকডাউনের এই সময়টাতে স্মার্ট টিভিতে গেমস খেলে, টেলিভিশন দেখে, কোরআন পড়ে, নামাজ শিখে সময় কাটে। তবে লকডাউন কি এটা সে জানে না। তার মতে করোনা একটি মহামারী। তবে বাসার বাইরে না যেতে পারায় প্রচুর মন খারাপ হয় রাজীর। লকডাউন শেষ হলে সবার আগে স্কুলে যেতে চায় রাজী। স্কুলের বন্ধুদের ভীষণ মনে পড়ে তার। অন্যান্য সময় রোজা না রাখা হলেও এবার সে হোম কোয়ারেন্টিনে রোজা থাকবে। রাজীবের ছোটো ফুফু শামীম আরা স্নীগ্ধা জানায়, কিছুক্ষণ পর পর দৌড়ে গিয়ে বলে ফুপি আমার আর কিছু ভালো লাগে না। আগে বাইরে খেতে যেতো। প্রতি শুক্রবার ঘুরতে যেত। এখন সেটাও বন্ধ। লকডাউনের কারণে প্রাইভেট টিউটর বাসায় আসতে পারেনা গত এক মাস ধরে। তিন বছর বয়সী ছোটো বোন নাফিসা বিনতে মোস্তফার সঙ্গে মাঝে মধ্যে খেলাধুলা করে। জোরাইরা রহমান নামিরা। বয়স ৬ বছর। মা সংবাদকর্মী। বাবা ব্যবসায়ী। ধানমন্ডির ওয়াই ডব্লিউ সি এ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাজধানীতে বসবাস করে। নামিরা জানায়, এখন পড়ালেখা করছি। কিছুক্ষণ আগে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস করেছি। সারাদিন বাসায় বসে ড্রইং করি। লকডাউন বলতে নামিরার মতে, লকডাউনের কারণে ঘরে বন্দি আছি। এক প্রকার শাস্তি পাচ্ছি। বাইরে যেতে পারছি না। বাসায় বসে খেলাধুলা করি। কার্টুন দেখি। বাবা-মা, ভাইয়ার সঙ্গে গল্প করি। স্কুলে যেতে পারিনা। কোথাও বেড়াতে যেতে, খেলতে পারি না। বন্ধুদের খুব মিস করছি। নামিরার মা রহিমা রেখা বলেন, বাসায় বন্দি থেকে কিছুটা স্বভাবগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে নামিরার। অল্পতেই রেগে যার। অনেক সময় কথা শুনতে চায়না। খেলনা নিয়ে বারবার বাসার বারান্দায় যায়। বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটে থাকা বন্ধুদের ডাকাডাকি করে। বাইরে যাওয়ার জন্য কান্না করে। ফোনে স্কুলের টিচারের সঙ্গে কথা বলে। বাসায় ছাদ না থাকাতে বারান্দায় খেলাধুলা করে। মিয়াদ আরবিন আয়ানের বয়স পাঁচ বছর। বরিশাল শহরের এপেক্স আইডিয়াল স্কুলের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বাবা-মায়ের সঙ্গে বরিশাল শহরে থাকে। বাবা মিজানুর রহমান একটি বেসরকারি সেবাদানমূলক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেণ। মা মরিয়ম আক্তার গৃহিনী। লকডাউনের কারণে গত একমাস ধরে গ্রামের বাড়িতে আছে। লকডাউন কি জানতে চাইলে আয়ান জানায়, লকডাউন হচ্ছে সে নানার সঙ্গে বাজারে যেতে পারে না। স্কুলে যেতে পারে না। বাসায় থাকতে হয়। বাসায় থাকতে এখন আর ভালো লাগে না তার। করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে আয়ান বলে, করোনা হচ্ছে একটি ভাইরাস। এটা চীন থেকে এসেছে। আয়ানের মা মরিয়ম জানায়, লকডাউনের আগে পড়ালেখার প্রতি যে আগ্রহ ছিলো সেটা এখন আর নেই। বাসায় বসে যতটুকু সম্ভব ছেলেকে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করি। সেটা হতে পারে লুডু, মোবাইল গেইম ও অন্যান্য খেলা। করোনায় এই সময়ে লকডাউনে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, প্রথমত, এখন শিশুরা ঘরে বন্দি আছে। আগে যে ওরা খুব বেশি বাইরে ঘোরাঘুরি করতো এমনটা নয়। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে পরিবারের সদস্যরা এখন বাসায় আছেন। ফলে সবসময় বাচ্চাদেরকে কারেক্ট ওয়েতে নেওয়ার (বেশি বেশি শাসন করা) চেষ্টা করা হয়। বিদেশে বাচ্চাদেরকে তাদের মত ছেড়ে দেওয়া হয়। ওরা ওদের মত গ্রো করুক। বাংলাদেশে উল্টো চিত্র। একটি পদক্ষেপ ফেলার আগে বাবা-মা বলেন, এটা করোনা, ওটা করোনা। যেহেতু এখন সবাই বাসায় আছেন। ফলে খুবই একটি সম্ভাবনা আছে গার্ডিয়ানরা এগুলো বেশি করছেন। যেটা শিশুদের জন্য কঠিন হতে পারে। এতে করে নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় শিশুদের। সবাই যেহুতু বাসায় আছে তাই সবার মত করে ওকে (শিশু) চলতে হচ্ছে। শুধু নিষেধাজ্ঞা না ওর গতিবিধিগুলো অন্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাচ্চারা খুব এ্যটেনশন বা ইন্টারেকশন পছন্দ করে। এখন কিন্তু পরিবারের প্রত্যেকের সঙ্গে ইন্টারেক্ট করার সুযোগ পাচ্ছে। বাচ্চাদের অনেক সময় বোকা ভাবা হয়। কিন্তু তারা প্রচুর শিক্ষা নেয় অন্যদের কাছ থেকে। সুতারং আমরা চাইলে এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাদের পজেটিভ অভ্যাস তৈরি করতে পারি।