নিউজ ডেস্কঃ
আপনি কখনো ভালো করে বিভিন্ন মাছের গায়ে আঁশ গুলো যদি লক্ষ করেন, তবে আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন যে, মাছের আঁশগুলিতে খুব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে। এগুলি সাধারণত রূপালী চকচকে, আবার অনেক মাছের প্রকার ভেদে কখনও কখনও গোলাপী বা বেগুনি বা বাদামী রঙের ছোঁয়াযুক্ত সুন্দর বর্ণের হয়। এগুলির মধ্যে সত্যিই খুব সূক্ষ্ম সুন্দর টুকরো গহনার মত দেখতে পাবেন। তাহলে, কেন সেগুলি থেকে নিজে কিছু সাজসজ্জা তৈরি করবেন না? আপনি আপনার কল্পনার পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে পারেন। আপনার যদি পর্যাপ্ত ধৈর্য না থাকে, বা এই জাতীয় সময়সাপেক্ষ কাজের কোনও বড় অনুরাগী না হন, তবে এরকম মাছের আঁশের জিনিস কিনে মন ভরাতে পারেন। মাছের আঁশ থেকে এরকম জিনিস তৈরির ধারণাটি অনেক পুরনো। মাছের আঁশ থেকে উপকরণ তৈরি বহু প্রাচীণ একটি পদ্ধতি। আমাদের আগে বহু মানুষ, বহু শতাব্দী ধরে, সুন্দর জিনিসগুলি তৈরি করতে মাছের আঁশ ব্যবহার করে আসছে।
বর্তমানে, থাইল্যান্ডের ফুকেট সিটিতে মাছের আঁশের বিভিন্ন অলংকরন তৈরি করে বিক্রি করেন ওখানকার মহিলারা। এছাড়া চীন, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে বহুল প্রচলিত হচ্ছে মাছের আঁশের উপকরণ। অনলাইনেও মাছের আঁশের বিভিন্ন উপকরণ পাওয়া যাচ্ছে। তবে নিজে তা তৈরি করে নিতে পারেন সহজেই। আমাদের রাজ্যে মৎস্য দপ্তরের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্লকে মাছের আঁশ থেকে এই রকম উপকরণ তৈরির জন্য স্বনির্ভর দলের মহিলাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। মৎস্য দপ্তরের জুনপুট মৎস্য প্রযুক্তি সেন্টারে মাছের আঁশ থেকে হস্তশিল্পের ওপর রাজ্যস্তরীয় প্রশিক্ষণও হয়েছে।
যদিও দামের বিষয় হিসাবে, মাছের আঁশকে হীরা, সোনার বা মূল্যবান পাথরের সাথে তুলনা করা যায় না, ফিশ স্কেলের গহনাগুলি অন্যান্য গহনার শৈলী এবং উপকরণগুলির মধ্যে একটি বিশেষ স্থান অর্জন করেছে। কম দামে এক আধুনিক ছোঁয়ায় এটি এখন আবার খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে।
কানাডার একটি কলেজ রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, আলবার্তায় রেড ডিয়ার কলেজ, যেখানে “মিক্সিং বিডেস এবং ফিশস্কেল আর্ট” শিরোনামযুক্ত একটি কোর্স রয়েছে। “ফিশ স্কেল আর্ট” এই অঞ্চলে একটি উপযোগী শিল্প হিসাবে গণ্য করা হয়।
বাঙ্গালী মানেই মাছ। তবে মাছ বাজারে গেলে চোখে পড়বে অজস্র আঁশ। আর মাছের আঁশ বলতে আমরা সাধারণত মাছের উচ্ছিষ্ট অংশ বুঝে থাকি, যা আমরা সচরাচর ফেলে দিয়ে থাকি। কিন্তু এই আঁশ নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা বিধ গবেষণা করছেন ও উন্নত দেশে কাজে লাগছে এই আঁশ। যেমন বিশেষ কিছু মাছের আঁশ (যেমন: তেলাপিয়া) মানুষের পুড়ে যাওয়া অংশে চামড়া প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য গবেষণা চলমান রয়েছে। আবার মাছের আঁশ থেকে ঔষুধ ক্যাপসুলের মোড়ক তৈরি হয়। মহিলাদের সাধের প্রসাধনী লিপস্টিক ও নেল পলিশের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান হলো মাছের আঁশ থেকে আহরিত গুয়ানিন যৌগ। এই গুয়ানিন ব্যবহারের ফলে এই ধরনের প্রসাধনীর উজ্জ্বল ভাব ও স্থায়িত্ব বজায় থাকে। তাছাড়া মেকআপ ও ব্লাশ তৈরিতেও ব্যবহার হয় মাছের আঁশ থেকে আহরিত এই যৌগ। আবার মাছের আঁশের নির্যাস থেকে তৈরি হচ্ছে মুক্তা, তৈরি হচ্ছে সার। এগুলোর জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির প্রয়োজন।
ঘর সাজাতেও কাজে লাগে মাছের আঁশ। এই আঁশ থেকে ঘরে বসেই নানাবিধ জিনিস তৈরি করা যায়। অতি সহজেই হয় এই আঁশের ব্যাবহার। এই আঁশ দিয়ে পরিবেশবান্ধব নানা সামগ্রী তৈরি করা যায় । এমনকি এর দ্বারা স্বনির্ভরও হতে পারেন। হ্যাঁ, বর্তমানে ফেলে দেওয়া মাছের আঁশ কুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে তা থেকে হার, দুল এমন সব হস্তশিল্প। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে মনীষীদের প্রতিকৃতিও । একটা দুল তৈরি করতে খরচ পড়বে কমবেশি দশ টাকা। বাজারে বিক্রি করলে আয় হবে খরচের তিন-চার গুণ টাকা। যত বড় মাপের মাছ হবে, তত এই সূক্ষ্ম কাজ করতে সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে দুই থেকে পাঁচ কেজি ওজনের মাছের আঁশে ভাল ভাবেই বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা যায়।
তবে মাছের আঁশ থেকে কি কি ধরনের অলংকার তৈরি করা যায় ? মাছের আঁশের ফুলদানী , মাছের আঁশের ডোর বেল, “উইন্ড চাইমস”, গলার অলংকার হার, নেকলেস, মাছের আঁশের দুল , মাছের আঁশের আংটি, মাছের আঁশের ব্রেসলেট বা কাঁকন, মাছের আঁশের কৃত্রিম নখ, মাছের আঁশের চুলের ফিতা, মাছের আঁশের চুলের আংটা, মাছের আঁশের অলংকরন করা ঘর সাজানো বল, মাছের আঁশের মেয়েদের টাকা রাখার ব্যাগ ইত্যাদি আরো নানান ঘর সাজানোর উপকরণ।
ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য আঁশ গুলোকে প্রথমে যত্ন নিতে হবে। এরজন্য কিভাবে কি করতে হবে ? মাছের বাজার থেকে অব্যাবহৃত মাছের আঁশ সংগ্রহ করে আনতে হবে। প্রথমে আঁশ ঝাড়াই-বাছাই করতে হয়। এরপর অ্যাসিড জলে আঁশ গুলো ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। আঁশ ধোয়ার পর ফের কোনও ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সাবান জলে আঁশ গুলিকে সারারাত ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে। এতে মাছের আঁশের আঁশটে গন্ধ একেবারে চলে যবে। এর পর আঁশ গুলিকে পরিস্কার জলে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। ধোয়ার পর ভাল করে সেগুলি শুকিয়ে নিতে হবে। আঁশ গুলি শুকানোর জন্য রোদে ফেলে রাখতে হবে। শুকানোর পর কাগজ দিয়ে ঘষে নিতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে দেখবেন আঁশ গুলো চকচক করছে। আর এই আঁশের জেল্লা দেখলে অবাক হতে হয়। নতুন রূপে ধরা দেওয়া সেই আঁশ উজ্জ্বলতায় অনেক কিছুকে টেক্কা দিতে পারে।
এবার এই আঁশ গুলো বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরি করার জন্য উপযোগী হয়েছে।
ধরুন এবার যদি মাছের আঁশের ফুলদানি তৈরি করতে চাই আমরা। প্রথমে জানতে হবে একটি মাছের আঁশের ফুলদানী তৈরি করার জন্য আর কি কি উপকরণ লাগবে ? প্রস্তুত করা মাছের আঁশ-এর সাথে লাগবে রঙ, আঁঠা, কাঁচি ও অ্যালুমিনিয়াম তার।
মাছের আঁশ গুলোকে বিভিন্ন রঙ লাগিয়ে দিতে হবে। এর পর পছন্দ মতো রঙ্গীন আঁশ গুলো আঁঠা দিয়ে লাগিয়ে লাগিয়ে বিভিন্ন ফুলের, পাতার সাজ দিতে হবে। এরপর অ্যালুমিনিয়াম তার দিয়ে ফুল, পাতা সহ ফুলদানীর রূপ দিতে হবে।
আবার আঁশ গুলো থেকে তৈরি করে নিতে পারেন মহিলাদের বিভিন্ন অলংকার যেমন গলার হার, দুল ইত্যাদি। এর জন্যও উপকরণ হিসেবে প্রস্তুত করা মাছের আঁশ, কাঁচি, শক্ত সুতো, সরু ধাতব তার, চকচকে স্টেশনারি উপাদান, অভ্র ও আঁঠা। আর নিজের মতো শিল্পী মন দিয়ে তৈরি করে ফেলুন গলার অলংকার হার, নেকলেস, মাছের আঁশের দুল, মাছের আঁশের আংটি, মাছের আঁশের ব্রেসলেট বা কাঁকন ইত্যাদি।
বাচ্চাদের ছোট প্লাস্টিকের খেলার বল নিয়ে প্রস্তুত করা মাছের আঁশে বিভিন্ন রঙের রঙ লাগিয়ে নিন। প্রয়োজনে নখ পালিসের রঙও ব্যাবহার করতে পারেন। এবার আঁঠা দিয়ে ঐ রঙিন আঁশ গুলো বলটাতে লাগাতে থাকুন। পুরো বলে বিভিন্ন রঙের আঁশ লাগিয়ে দেওয়ার পর দেখুন কি সুন্দর একটা “শো-পিস” তৈরি হয়েছে।
এরকম ভাবেই আঁশ থেকে তৈরি করুন আরো বিভিন্ন হাতের কাজ। আর এই মাছের আঁশ থেকে অলংকরন, বল, গণেশ, ময়ূর, হরিণের মতো শো-পিস থেকে মহিলাদের নানারকম অলঙ্কার তৈরি করা যাবে মাছের আঁশ থেকে। সূক্ষভাবে প্রয়োজনে আঁশ গুলো বিভিন্ন ভাবে কাঁচি দিয়ে কেটে আর আঁশের সঙ্গে সামান্য আঠা লাগিয়েই এই অপরূপ কাজ করে করতে হবে। এই আঁশের সামগ্রী এতটাই শক্ত যে ভাঙবে না।
সুতরাং, হাতের কাছের খুব অল্প মূল্যের উপকরণ আর মনের সৃজনশীলতায় এই সব অব্যবহৃত ফেলে দেওয়া মাছের আঁশ থেকে অনেক কিছুই বানিয়ে নিতে পারেন। একে কুটিরশিল্পের মতো কাজে লাগিয়ে করা যায় উপার্জন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা থেকে এলাকার বেকার যুবকদের এই কাজ কর্মংস্থানের নতুন দিক।
এবার বাড়িতে মাছ কিনে আনার পর, তার আঁশ আর এদিক ওদিক ফেলে না দিয়ে নিজের ঘর সাজাতে, মাছের আঁশের বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে রঙ বেরঙ-এ ভরিয়ে তুলুন বাড়ি, কিংবা কিছু বানিয়ে উপহার দিয়ে প্রিয়জনের মন জয় করুন, হাসি ফুটুক মনে ও পরিবেশে।
সুত্রঃ কৃষি জাগরন