মাছের মুড়ার দানা ৯০ লাখ টাকা কেজিমাছের মুড়ার দানা ৯০ লাখ টাকা কেজি

মাছের মুণ্ডু তথা মুড়ার দানা এক মহার্ঘ বস্তু। মাছের কৃত্রিম প্রজননে উদ্দীপনা তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়। এর নাম পিটুইটারি গ্ল্যান্ড (পিজি)। প্রতি গ্রাম ৬–৯ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সেই হিসাবে এক কেজির দাম ৬০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। দেশে বছরে পিজির চাহিদা ৫০ কেজি। অর্থাৎ দেশে ৪৫ কোটি টাকার বাজার রয়েছে পিজির। আরও ৫০ কেজি পিজি সংগ্রহ করা সম্ভব, যার রপ্তানিমূল্য ৪০–৪৫ কোটি টাকা।

পিজি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশ এবং এ ব্যবসায় জড়িত স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের বাজারে প্রতি গ্রাম পিজি মানে মুড়ার দানা ৬ থেকে ৯ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সেই হিসাবে এক কেজির দাম ৬০ লাখ থেকে ৯০ লাখ টাকা। আর দেশে বছরে প্রায় ৫০ কেজি পিজির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শুকনা পিজি পাওয়া যায় ৭ থেকে ৮ কেজি। বাকি ৪২ কেজির সিংহভাগই প্রতিবেশী ভারত এবং কিছুটা চীন থেকে আমদানি করা হয়।

হ্যাচারিমালিকেরা মাছের কৃত্রিম প্রজননে উদ্দীপক হিসেবে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড (পিজি) ব্যবহার করেন। দেশে অবশ্য ১৫ কেজির মতো কৃত্রিম বা সিনথেটিক পিজি ব্যবহার হয়। এটির কেজি ২৭ থেকে ২৮ লাখ টাকা।
চীনা ই–কমার্স আলিবাবা এবং মেড ইন চিনা নামের আরেক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, গত শনিবার প্রতি গ্রাম পিজির দাম ছিল ৮০ থেকে ১১০ মার্কিন ডলার। এর মানে প্রতি কেজির দাম ৬৮ লাখ থেকে ১ কোটি ৩ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে)।

কার্পজাতীয় যেসব মাছের মুড়ার দানা এত দামি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ, কার্ফু, কার্ভ, সিলভার কার্প ইত্যাদি।
ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে পিজির মোট চাহিদা এক হাজার কেজি। তবে ২২টি দেশে এটির চাহিদা বেশি। দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ইউক্রেন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ভেনিজুয়েলা, কাজাখস্তান, মিসর ও টোগো।
বাংলাদেশে এখনো পিজির বাজার বেশ ছোট। তবে পিজি সংগ্রহ থেকে শুরু করে তা প্রয়োগ করা পর্যন্ত একটি বাজারব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি জেলায়। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছেন বাজারে মাছ কাটার বঁটিওয়ালা, পিজি সংগ্রাহক, প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও হ্যাচারিমালিকেরা। ভেজা পিটুইটারি গ্ল্যান্ডও (পিজি) ব্যবহার করা যায়। তবে শুকনা পিজি ব্যবহার করলে মাছের পোনা উৎপাদন প্রায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় বলে জানান হ্যাচারির মালিক ও কর্মকর্তারা।

দেশে যাঁরা পিজির ব্যবসা শুরু করেছেন, তাঁদের একজন যশোরের লিয়াকত আলী। তাঁর প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড অ্যাগ্রো ফিশারিজ বছরে ছয় কেজি শুকনা পিজি উৎপাদন করে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে মাছের বাজারের এখন যে অবস্থা, তাতে অন্তত ১০০ কেজি শুকনা পিজি তৈরি করা সম্ভব, যা দিয়ে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে।

লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে জানান, তিনি ১৯৮৫ সালে নদী থেকে মাছের রেণু সংগ্রহ করে পোনা উৎপাদনের ব্যবসা শুরু করেন। এর ২২ বছর পর ২০০৭ সাল থেকে তিনি শুকনা পিজির ব্যবসায় জড়িত হন। তিনি বলেন, ‘তখন বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় মাছের কৃত্রিম প্রজননে দেশে মাত্র পাঁচটা হ্যাচারি গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে যশোরে ছিল একটি হ্যাচারি। সেখান থেকে পোনা নিয়ে আমি বাজারে বিক্রি করতাম। হ্যাচারিগুলোতে কৃত্রিম প্রজননের উদ্দীপক হিসেবে পিজি লাগত। তাই আমাকে তারা এ রকম কিছু পাওয়া যায় কি না, সেটি খোঁজ করতে বলে আমাকে।’

হ্যাচারিমালিকদের ফরমাশমতো লিয়াকত মৎস্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর যুক্তরাজ্য থেকে আসা একজন প্রশিক্ষকের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন ওই কর্মকর্তারা। বিদেশি প্রশিক্ষক কীভাবে মাছ থেকে পিজি নেওয়া যায়, সেটি লিয়াকতকে শেখান। সে অনুযায়ী তিনি মাছবাজারের বঁটিওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে পিজি সংগ্রহে নেমে যান। বঁটিওয়ালাদের কাছ থেকে ভেজা (অপ্রক্রিয়াজাত) পিজি কিনে তিনি হ্যাচারিতে বিক্রি শুরু করেন।

নব্বইয়ের দশকে দেশজুড়ে মাছ উৎপাদন বাড়াতে নানা কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও রাসায়নিক উপাদান আসত। এর মধ্যে একটি উপাদান ছিল পিজি সংক্রান্ত। ব্যস, এবার লিয়াকত শুকনা পিজি তৈরির কাজে মনোযোগ দেন। এতে সফলও হন। মৎস্য অধিদপ্তরের মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগ ২০১৩ সালে তাঁকে প্রক্রিয়াজাত পিজি বিক্রির অনুমতি দেয়।

লিয়াকত জানান, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ১০০ বঁটিওয়ালাকে মাছ কাটার সময় কীভাবে পিজি সংগ্রহ করতে হয়, তা শেখান। এ ছাড়া ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড নিউট্রিশন অ্যাকটিভিটি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় আরও ৩০০ বঁটিওয়ালাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটি ছিল ওয়ার্ল্ডফিশের একটি প্রকল্প। এসব বঁটিওয়ালার কাছ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে ভেজা পিজি সংগ্রহ করেন লিয়াকত। এরপর তা প্রক্রিয়াজাত করে তিনি প্রতি গ্রাম ৬ থেকে ৯ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন।

জানতে চাইলে ওয়ার্ল্ডফিশের বাজারব্যবস্থা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হাসনাল আলম বলেন, মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হলে একটা না একটা উদ্দীপক লাগেই। যদি প্রাকৃতিক পিজির ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে কৃত্রিম পিজি ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু কৃত্রিম পিজি মাছের শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
এদিকে স্থানীয় মাছবাজারগুলো থেকে পিজি সংগ্রহের উদ্যোগে লাভবান হয়েছেন বঁটিওয়ালারাও। একটি মাছ কেটে যেখানে তাঁরা ১০ টাকা আয় করেন, সেখানে এক দানা পিজি বিক্রি করতে পারলে সাত থেকে আট টাকা পান। অর্থাৎ পিজি সংগ্রহ করে বিক্রি করতে পারলে মাসিক আয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায় একজন বঁটিওয়ালার, যা স্বল্প আয়ের এই মানুষগুলোর জীবনমানের উন্নয়নে সহায়ক হয়।

যশোর–চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড বাজারের বঁটিওয়ালা নাসরিন খানম জানান, পিজি সংগ্রহের কাজ শুরু করার পর থেকে তাঁর সংসারে মোটামুটি সচ্ছলতা এসেছে।
ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখে এখন আরও কিছু প্রতিষ্ঠান পিজি প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবসায় নেমেছে। এদের একটি হলো খুলনার ফিশটেক হ্যাচারি। ওয়ার্ল্ডফিশের সহায়তায় আগামী মাস থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।

লিয়াকত আলীর ইউনাইটেড অ্যাগ্রো ফিশারিজের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের মাছবাজারগুলোতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার বঁটিওয়ালা আছেন। এর অর্ধেকের কাছ থেকেও যদি পিজি সংগ্রহ করা যায়, তাহলে দেশে যে ৫০ কেজি পিজির চাহিদা রয়েছে, সেটি পূরণ করে আরও ৫০ কেজি বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। তাতে প্রায় ৪০–৪৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

সুত্রঃ প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *