রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি খাদ্যমূল্যও বাড়ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছে, যুদ্ধের কারণে এ বছর বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। খাদ্যের দাম বাড়লে অবধারিতভাবে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি টু সিস্টার্সের প্রধান নির্বাহী রোনাল্ড কার্স বলেছেন, এই যুদ্ধের জেরে খাদ্যমূল্য ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে।
রোনাল্ড কার্স আরও বলেছেন, খাদ্য তৈরিতে তাঁদের বিপুল পরিমাণে মুরগি কিনতে হয়। কিন্তু যুক্তরাজ্যের বাজারে মুরগির দাম ইতিমধ্যে অনেকটাই বেড়েছে। ফলে তাঁদের প্রস্তুত করা খাদ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় আটা উৎপাদনকারী কোম্পানি জিআর রাইট অ্যান্ড সন্স বিবিসিকে বলেছে, যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম বাড়তে বাধ্য।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। বৈশ্বিক পরিসরে রুটির ভান্ডার হিসেবে তাদের খ্যাতি আছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে যবের ১৯ শতাংশ, গমের ১৪ শতাংশ ও ভুট্টার ৪ শতাংশ তারা রপ্তানি করে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যশস্যের জোগান দেয় এই দুই দেশ।
এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে ইউক্রেন শস্য উৎপাদন করতে পারবে কি না এবং করলেও রপ্তানি কতটা করতে পারবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। এ ছাড়া যুদ্ধের কারণে ভবিষ্যতে রাশিয়ার পণ্য রপ্তানিতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের এই সংস্থা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি কর্মসূচির মহাপরিচালক কিউ দোং এক বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, শীর্ষ এই দুই রপ্তানিকারক দেশের সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।
খাদ্যমূল্য নিয়ে নিয়মিত সূচক প্রকাশ করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও। ফেব্রুয়ারি মাসে সংস্থাটির খাদ্যমূল্যসূচক রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে। চলমান সংঘাতের ফলে অনিশ্চয়তা আরও তীব্র হয়েছে। সরবরাহের ঘাটতির কারণে বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের দাম ৮ থেকে ২২ শতাংশের বেশি বাড়বে বলে উদ্বেগ জানিয়েছে এফএও।
এদিকে চলমান যুদ্ধের কারণে ২০২২-২৩ সালে ইউক্রেনে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে এফএও। শীতকালীন শস্য, ভুট্টা, সূর্যমুখীর আবাদ কমে যাবে। বিষয়টি হচ্ছে, যুদ্ধের কারণে দেশটির ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জমি অনাবাদি থাকবে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি। স্বল্পোন্নত দেশসহ বিশ্বের ৫০টি দেশে ৩০ শতাংশের বেশি গম রপ্তানি করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। ফলে এসব দেশেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে এফএও বলছে, ২০২২-২৩ সালে বিশ্বে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি ৩ লাখে পৌঁছাবে, যার প্রভাব পড়বে এশিয়াসহ আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল আর পূর্ব, উত্তর আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলে।
এ অবস্থায় জাতিসংঘের এই সংস্থা অন্যান্য দেশকে রুশ পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ না করার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের ময়দা প্রস্তুতকারক কোম্পানি জিআর রাইট অ্যান্ড সন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড রাইট বিবিসিকে বলেছেন, ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব অনিবার্যভাবে ভোক্তাদের ওপরই পড়বে, তাদের পক্ষে তো আর ক্ষতিবৃদ্ধি করে ব্যবসা করা সম্ভব নয়।
যুক্তরাজ্যের পাউরুটির বাজারের ৪৪ শতাংশ হিস্যা এই জিআর রাইট অ্যান্ড সন্সের। তারা বলছে, যুদ্ধ শুরুর আগে দুই বছর ধরে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। এর মধ্যে আবার শুরু হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যুদ্ধের কারণে যার পালে আরও হাওয়া লাগবে বলেই শঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
ডেভিড রাইট বিবিসিকে বলেন, ‘এখন আবার সেই পরিমাণ (ইউক্রেনের কারণে দামের) ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, চার মাসের পরিবর্তে এখন দুই সপ্তাহ লাগছে।’
ব্যয়ের বিষয়টি কিছু পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যেতে পারে। রাইটের তথ্যানুসারে, গমভর্তি প্রতিটি লরির এখন অতিরিক্ত ২ হাজার ৫০০ পাউন্ড বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। তাদের প্রতিদিনের প্রায় ২০ লরি আটা কিনতে হয়, সেই হিসাবে ব্যবসা চালাতে প্রতি মাসে তাদের অতিরিক্ত ১০ লাখ পাউন্ড ব্যয় করতে হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, ৩০ বছরের মধ্যে যা এখন সর্বোচ্চ। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটবে বলেই আশঙ্কা।
সুত্রঃ প্রথম আলো