রপ্তানিতে ধস, ধ্বংসের পথে কাঁকড়া শিল্পরপ্তানিতে ধস, ধ্বংসের পথে কাঁকড়া শিল্প

নিউজ ডেস্কঃ
করোনা ভাইরাস ও চীনের দেওয়া শর্তের কারণে টানা প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় চীনে কাঁকড়া রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে একদিকে যেমন সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন কাঁকড়া শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত খামারি ও ব্যবসায়ীরা।

বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার সুন্দরতলা গ্রামের কাঁকড়া চাষি হাফিজুর খান হতাশার সুরে বলছিলেন এসব কথা।

তিনি জানান, তার একটি কাঁকড়া খামার রয়েছে। যেখানে রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া থাকলেও ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন না। করোনার আগে ভালো গ্রেডের কাঁকড়া যেখানে ২৫০০-৩০০০ টাকা দরে কেজি বিক্রি করতেন তা এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ২০০-৩০০ টাকা দরে।

তিনি জানান, এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি কাঁকড়া চাষ করা হয় মোংলা ও রামপাল উপজেলায়। রপ্তানি বন্ধ থাকায় পানির দরে তারা কাঁকড়া বিক্রি করছেন।

অনুরূপভাবে খুলনার পাইকগাছা এলাকার কাঁকড়া চাষি আব্দুল্লাহ বলেন, চীনে কাঁকড়া রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমরা কাঁকড়ার কোনো দাম পাচ্ছি না। অথচ লোন নিয়ে কাঁকড়া চাষ করেছি। ব্যাংকঋণের চাপ আর পরিবার-পরিজন নিয়ে রীতিমতো এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।

কাঁকড়া শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এবং সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ ব্যবসায়ী ও খামারিদের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক করতে সরকারের কাছে অবিলম্বে চীনে কাঁকড়া রপ্তানি কার্যক্রম চালুর দাবি জানান তিনি।

মোংলার বৈদ্যমারী কাঁকড়া সমবায় সমিতির সভাপতি সুদীপ মন্ডল বলেন, করোনা পরিস্থিতি ছাড়াও কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধে ভিন্ন কারণ রয়েছে।

তার দেওয়া তথ্য মতে, যেসব প্রতিষ্ঠান চীনে কাঁকড়া রপ্তানি করে এমন ৫টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে কাঁকড়া পাঠাতে যেসব কাগজপত্র প্রয়োজন তা কারসাজির মাধ্যমে জাল কাগজ পাঠিয়েছে। যা চীনের কাষ্টমস কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে। পরে ওই ৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। যে কারণে দেশের অন্যতম অর্থকরি শিল্প কাঁকড়া চীনে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ৯০-৯৫ শতাংশ কাঁকড়া চীনে রপ্তানি হয়। অথচ সেই চীনেই কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ। অন্য দেশে বর্তমানে সামান্য কাঁকড়া রপ্তানি চালু হলেও চীনে কাঁকড়া রপ্তানি চালু না হলে ক্ষতির শেষ থাকবে না ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের।

ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে চীনে কাঁকড়া রপ্তানি চালুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে দক্ষিণাঞ্চল থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে ১২৮.৫২ মেট্রিক টন। করোনার কারণে জানুয়ারি-মার্চে রপ্তানি কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৯৬ মেট্রিক টন।

চীনে কাঁকড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে ঘেরের বর্ণনা, পানি, তাপমাত্রা, পরিবেশ, চাষির তথ্য, কাঁকড়ার মান যাচাই, স্বাস্থ্য সনদসহ বেশ কয়েকটি নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। জটিল এ শর্ত মেনে কাঁকড়া রপ্তানি কঠিন হয়ে পড়েছে। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় কাঁকড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৫ লাখ মানুষ।

বাংলাদেশে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর সময় থেকে এসব মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। উপায় না পেয়ে বিভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছেন অনেকে। চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও হংকংসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ কাঁকড়া শুধু চীনেই রপ্তানি হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় হওয়ায় খুলনাঞ্চল কাঁকড়া উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানকার উৎপাদিত শিলা কাঁকড়া সুস্বাদু হওয়ায় বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, রপ্তানি হওয়া কাঁকড়ার ৮০-৮৫ শতাংশই প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরণ করা। বাকিটা খামারে পরিচর্যা করে (ফ্যাটেনিং) রপ্তানি হয়।

রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান দিপু এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার তপন সরকার বলেন, করোনা ভাইরাস পরীক্ষাসহ ঘেরের বর্ণনা, পানি, তাপমাত্রা, পরিবেশ, চাষির তথ্য, কাঁকড়ার মান যাচাই, স্বাস্থ্য সনদসহ চীন প্রায় ১৮টি শর্ত দিয়েছে। যার অনেকগুলো পূরণ করা অনেক কষ্টকর। এসব শর্তের মধ্যে এমনও পরীক্ষা আছে যা করতে ৬ দিন সময় লাগে। কিন্তু খামার থেকে এনে পরীক্ষা করাতে ৬ দিন ধরে কাঁকড়া রাখলে তা মরে যায়। বা মান নষ্ট হয়ে যায়।

তিনি কাঁকড়া রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে চীনকে শর্ত শিথিলের দাবি জানান।

খুলনার পাইকগাছা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি দেবব্রত দাস বলেন, এক সময় চিংড়ি মাছ ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সময়ের ব্যবধানে সেই দিন এখন ফুরিয়ে গেছে। এখন চিংড়ির স্থান সর্বত্র দখল করেছে জলজ প্রাণী কাঁকড়া।

ভাইরাসজনিত কারণে চিংড়ির মড়ক, উৎপাদন খরচ বেশি ও বিদেশে দরপতনের কারণে চিংড়ি চাষিরা তাদের পেশার পরিবর্তন করেছেন। কম খরচে কম শ্রমে ব্যাপকহারে কাঁকড়া চাষ করছেন খুলনাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু চীনে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাঁকড়ার মূল্য বাবদ ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আটকা পড়েছে। লোকসানের মুখে পড়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে কাঁকড়া ব্যবসায়ী, চাষি ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন মানুষরা হতাশায় ভুগছেন। অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে কাঁকড়া রপ্তানির জন্য নতুন আন্তর্জাতিক বাজার খোঁজার দাবি করছেন তিনি।
সুত্রঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *