বাংলাদেশে আমের উৎপাদন প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কৃষিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নানামুখী উদ্যোগে বর্তমানে বিশ্বে আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে বাংলাদেশ। কিন্তু আম রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নেই দেশটি। রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, আম রপ্তানির প্রধান অন্তরায় পরিবহন খরচ বেশি ও নীতিমালা না থাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকা মূল্যের আড়াই লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। অর্থনীতিতে জোরালো ভূমিকা রাখে এ অঞ্চলের আম। গত দেড় বছরে করোনার কারণে মানুষের আয়ে কোনো প্রভাব পড়েনি আমের সঙ্গে বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত থাকার ফলে। তা ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতী আম পেয়েছে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি। এর পরও নানা কারণে রপ্তানিতে আম পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের আম অন্য যেকোনো দেশের আমের চেয়ে সুস্বাদু। কিন্তু আম পরিবহনে কার্গো খরচ অনেক বেশি। বাংলাদেশ ছাড়া যেকোনো দেশ বিমানে আম সরবরাহ করে অর্ধেকেরও কম খরচে।
এমটিবি অ্যাগ্রো অ্যান্ড গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী ও আম রপ্তানিকারক মো. মাহতাব আলী বলেন, ‘আম রপ্তানিতে দেশে তেমন নীতিমালা না থাকায় নিজেই হংকংয়ে সরকারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তাঁদের সহায়তাও পেয়েছি। দেশে নীতিমালা না থাকাটা অনেক বড় সমস্যা। কার্গো বিমানে ভাড়া অনেক বেশি।’
সুইডেনপ্রবাসী ও সুইডেনে আম আমদানিকারক একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান থেকে বিমানে সুইডেনে আম আসতে যে খরচ, বাংলাদেশ থেকে আসতে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি খরচ কার্গো বিমানে। পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারা যায় না। অথচ বাংলাদেশি আমের স্বাদ যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো ও চাহিদা অনেক বেশি।’ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস জানান, আম রপ্তানিতে কার্গো ভাড়া কমানো জরুরি। বৃহত্তর রাজশাহী সমিতি, ঢাকার সভাপতি প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘আম রপ্তানিতে আরো বেশি সরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন। রপ্তানি বাজার ও বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে আশির দশকে গার্মেন্টশিল্পে যেমনভাবে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনি আম রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়া জরুরি। আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে।’
তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশীয় আম বাগান পরিদর্শন করানো, আম রপ্তানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রীর ওপর ভর্তুকি প্রদান, বিদেশে সম্প্রসারণ করার জন্য সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করেন ভেজিটেবল রপ্তানি ও আমদানিকারকরা। এসব সমস্যার সমাধান করা হলে আম রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম জানান, আম উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম সারির দিকে থাকলেও রপ্তানিতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কারণ আধুনিক পদ্ধতিতে আম চাষ ও উন্নত বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, ট্রান্সপোর্ট কস্ট বেশি হওয়ায় আম রপ্তানি কম হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীকৃত আমের জাতের মধ্যে হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, হাড়িভাঙ্গা, আম্রপালি, ফজলি আম উল্লেখযোগ্য। এই দেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, গ্রিস ও সুইডেনে আম রপ্তানি হয়, যার পরিমাণ খুবই কম।
বিশ্বের প্রধান ১০টি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে থাকলেও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে কোনো অবস্থানে নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে আমবাগান রয়েছে। প্রতিটি গাছে গড়ে ৭৭ কেজি করে আম উৎপাদিত হয়। আম উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে ভারত। ২০১৯ সালে দেশটিতে আম উৎপাদিত হয় ২৫০ লাখ মেট্রিক টন, যা বিশ্ব উৎপাদনের প্রায় ৪৬ শতাংশ। আম উৎপাদনে ভারতের পরেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, চীন, মেক্সিকো ও পাকিস্তান। সুস্বাদু এ ফলের উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই উৎপাদিত হয় প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত ফলের রাজা আম।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৭ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমি থেকে ৮ লাখ ৮৯ হাজার ১৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। আমে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন থাকে। তা ছাড়া এই ফলে অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কাঁচা আম ফালি বা আমচুর, চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়। পাকা আম থেকে জুস, আমসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি তৈরি হয়। বর্তমান সরকার আমগাছের পরিচিতি, ফলের জনপ্রিয়তা, জাতীয় সংগীতে আমের স্থান এবং দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আমবাগানের নিবিড় সম্পর্ক থাকায় আমগাছকে ২০১০ সালে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করে।
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ