লবণাক্ততার বিরুদ্ধে লড়ছে কৃষকদের উদ্ভাবিত ধানলবণাক্ততার বিরুদ্ধে লড়ছে কৃষকদের উদ্ভাবিত ধান

জমির ক্রমশ বেড়ে চলা লবণাক্ততা আর ঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরার শ্যমনগরের কৃষক দিলীপ চন্দ্র তফাদারের জন্য ধান চাষ ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছিল৷ সে অবস্থা কাটাতে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান কাজে লাগালেন তিনি৷ বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের কিছু ধান সংগ্রহ করে সংকরায়ন পদ্ধতিতে উদ্ভাবন করলেন নতুন এক জাত৷ নাম দিলেন চারুলতা, যা লবণাক্ত মাটি, জলাবদ্ধতা, সেই সঙ্গে ঝড়ের বিরুদ্ধেও ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে৷ এমনকি সার বা বীজ ছাড়াই যথেষ্ট বাড়তে পারে চারুলতা, জানালেন দিলীপ৷

দিলীপ বলেন, একটা সময় ছিল যখন এখানকার মানুষ ধান চাষ করেই যথেষ্ট আয় রোজগার করতে পারতেন, অন্য কিছু করতে হতো না৷ তবে সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ যে কারণে বাঁচার তাগিদেই তারা নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এই কৃষক জানান তার উদ্ভাবিত জাতটির উৎপাদন প্রচলিত ধানের চেয়ে দ্বিগুণ৷

শুধু দিলীপ নন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর অঞ্চলের অন্য কৃষকরাও পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব নিজেরাই নিয়েছেন৷ শ্যামনগরের কৃষি কর্মকর্তা এস এম এনামুল ইসলাম বলেন, ‘এখানকার দুর্যোগ প্রবণ অঞ্চলের কৃষকরা অসাধারণ কাজ করেছেন৷ তারা স্থানীয় জাত সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন জাত উদ্ভাবন করে চলছেন৷’

কৃষি অফিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শ্যামনগরে প্রায় ৪৫ হাজার কৃষক রয়েছেন৷ ১৯৮০-এর দশক থেকে সেখানে চিংড়ি চাষের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার পর আশেপাশের কৃষি জমিতে বাড়তে শুরু করে লবণাক্ততা৷ ২০০৯ সালের সাইক্লোন আইলা এই পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তোলে৷ এরপর একের এক সাইক্লোনে জমি ক্রমশ লবণাক্ত হয়েছে, বহু কৃষক বাধ্য হয়েছেন ধান চাষ ছেড়ে দিতে৷

প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন নামের একটি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে শ্যামনগরসহ পাঁচটি এলাকার ৭৮ হাজার একর কৃষি জমি চিংড়ি ঘেরে পরিণত হয়েছে৷ সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনে নদীতে লবণাক্ততার পরিমান বাড়তে থাকায় কৃষকদের টিকে থাকাটাই ক্রমশ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে৷

এই পরিস্থিতিতে নতুন জাতের ধানই একমাত্র আশার আলো দেখাতে পারে, মনে করেন শ্যামনগরের নিকটবর্তী হৈবতপুর গ্রামের কৃষক শেখ সিরাজুল ইসলাম৷ তিনি নিজের ঘরেই একটি ধান গবেষণা কেন্দ্র চালু করেছেন৷ সেখানে মজুদ আছে ১৫৫ টি স্থানীয় জাতের ধান৷ এরিমধ্যে সিরাজুল দুইটি জাত আবিষ্কার করেছেন যেগুলো লবণাক্ত পানিতে টিকে থাকতে পারে৷ অঞ্চলটির ১০০ কৃষককে তিনি এই ধানের বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করেন৷

সমুদ্র উপকূলবর্তী বা নদীর তীরে লবণমিশ্রিত পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে এমন কিছু ধান চাষ করা যায় কীনা তা নিয়ে এখন গবেষণা করছেন সিরাজুল৷ তবে সেগুলো হয়ত ততটা পুষ্টিকর হবে না, বলেন তিনি৷ ধানের বীজ নিয়ে তার আরো বড় পরিকল্পনা রয়েছে৷ ‘আমি শহরে ধান বীজের বাজার গড়ে তোলার চিন্তা করেছি৷ সেখানে কোন বীজ বিক্রি হবে না, বরং কৃষকরা বীজ বিনিময় করবেন,’ নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন সিরাজুল৷

কৃষকদের এমন প্রচেষ্টা স্থানীয় পর্যায়ে কৃষির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির৷ দিলীপসহ বিভিন্ন কৃষকদের উদ্ভাবিত ধান বারিতে পাঠানো হয়েছে৷ কৃষকদের মধ্যে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সেগুলো তারা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখেন৷

বারির গবেষকরা নিজেরাও অন্তত ১০০ জাতের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন, যার কয়েকটি লবণাক্ত ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু৷ তবে শ্যামনগরের কৃষকরা বলছেন সেগুলোর বেশিরভাগই তাদের এলাকার উপযুক্ত নয়৷ থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে কয়েকজন জানান, অনেক জাতের ধান তাদের কাছে পৌঁছায় না, সেগুলো হয় উচ্চমূল্যের নয়ত তাদের অঞ্চলে চাষের মতো নয়৷ ‘আমি অনেকবার সেগুলো চাষ করেছি, কিন্তু ফলন ভালো না,’ এমনটাই মত কৃষক বিকাশ চন্দ্রের৷ তার বদলে তিনি এখন সিরাজুল ইসলামের উদ্ভাবিত একটি ধান চাষ করছেন৷

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ এর হিসাবে গত এক যুগে কৃষকরা নিজেরাই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষম ৩৫টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন৷ সেগুলোর বেশিরভাগই অবশ্য মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে৷ অলাভনজনক এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি শ্যামনগরের কৃষকদের নতুন জাত উদ্ভাবনে কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে৷ তাদের আঞ্চলিক সমন্বয়ক পার্থ সারথি পাল থমসন রয়টার্সকে বলেন, ‘শ্যামনগরের কৃষকরা নিজেরাই নিজেদের সমাধান খুঁজে পেয়েছেন৷ যে কারণে অনেক দুর্যোগ-প্রবণ অঞ্চলে ধান চাষ ফিরে এসেছে৷ এটি ভবিষ্যত কৃষকদের জন্য নতুন আশার আলো৷’
সূত্র : ডয়চে ভেলে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *