সরকারি সুবিধা নিয়েও চামড়ার ন্যায্যমূল্য দেয়নি ব্যবসায়ীরা

নিউজ ডেস্কঃ
কোরবানির ঈদের আগে চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাংক ঋণসহ বেশকিছু সুযোগ সুবিধার ঘোষণা দেয় সরকার। অনেক খেলাপি চামড়া ব্যবসায়ীও সেইসব সুবিধা নিয়েছেন সুযোগ বুঝে। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার সঠিক দাম দেননি।
জানা গেছে, প্রতিবছর কোরবানির ঈদের সময় নিজস্ব উদ্যোগ ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আড়তদার ও ডিলাররা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে তা সংরক্ষণ করেন। পরে ট্যানারিগুলো তাদের সুবিধা অনুযায়ী আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করে। এ বছর করোনা মহামারি, বন্যাসহ নানা কারণে এবার পশু কোরবানি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম হয়েছে। তাই ৭০ থেকে ৭৫ লাখ গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষের চামড়া সংগ্রহ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। আগামী এক দেড় মাসে আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এসব লবণযুক্ত চামড়া কেনা হবে।

এদিকে, বরাবরের মতো এবারও ঈদের আগে কোরবানির পশুর চমড়ার দাম ২০ থেকে ২৯ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করে দেয় সরকার। ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা গত বছর ছিলো ৪৫-৫০ টাকা। এক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় দাম কমানো হয় ২৯ শতাংশ। ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়, গত বছর যা ছিলো ৩৫-৪০ টাকা। এক্ষেত্রে গতবছরের চেয়ে দাম কমানো হয় প্রায় ২০ শতাংশ।

এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া ১৩-১৫ টাকা, গত বছর যা ছিলো ১৮-২০ টাকা। এক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে দাম কমানো হয় ২৭ শতাংশ। পাশাপশি, বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ১০ থেকে ১২ টাকা, গত বছর যা ছিলো ১৩-১৫ টাকা। এক্ষেত্রেও দাম কমানো হয় ২৩ শতাংশ।

কিন্তু এরপরও নির্ধারিত দামে কেনাবেচা হয়নি কোরবানির পশুর চামড়া। ন্যায্য মূল্য না পাওয়া ও সঠিক সময়ে চামড়া সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়ায় এবারও কোরবানিতে কমপক্ষে ২০ ভাগ কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়নি, যা নষ্ট হয়ে গেছে। বিক্রি হওয়া চামড়ার দামও ছিলো কম। প্রতিটি গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়ার দাম ছিলো মাত্র ১০ টাকা।

এ বিষয়ে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আগামী শনিবার থেকে ট্যানারির মালিকরা লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহ শুরু করবে। সরকার নির্ধারিত দামেই আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লবণযুক্ত চামড়া কেনা হবে। চামড়ার মান অনুযায়ী দাম দেয়া হবে।

খুচরা পর্যায়ে এবারও চামড়ার দাম নিয়ে নৈরাজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আড়তদারদের সঙ্গে আমরা সারা বছর ব্যবসা করি। তারা জানে, কোন চামড়ার কত দাম। কোরবানির ঈদের আগে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় শুধুমাত্র মৌসুমী ব্যবসায়ীদের জন্য। কিন্তু তারা বিষয়টি বুঝতে চান না। কত দাম দিয়ে কিনবে তাও জানে না। কখন আড়তে আনবে তাও অনেকে জানেন না। এ কারণে বাজারে অসংগতি সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে চামড়া সংগ্রহ করে পরের দিন আড়তে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছেন। ওই চামড়া তো নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে প্রতিবছরই মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতার অভাবে হাজার হাজার পশুর চামড়া নষ্ট হচ্ছে। এতে করে তারা একদিকে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অন্যদিকে দেশের সম্পদ নষ্ট করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সে দামকে কেউ পাত্তা দেয়নি। অনেক জায়গাতেই দুই থেকে তিনশ’ টাকাতেই বিক্রি হয়েছে গরুর চামড়া, খাশির চামড়ায় মেলেনি একশ টাকাও। এদিকে, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যূনতম কমপ্লায়েন্স না মানার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারাও বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করছে না।

এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের বিকল্প পদ্ধতি চালু করার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহের জন্য এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। গরুর হাটের মতো চামড়া সংগ্রহকারীর কাছেও একেকটি এলাকার ইজারা দেয়া যেতে পারে। আর চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ যেকোনোভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চামড়া তো কাঁচামাল, জরুরি এই কাঁচামালটি নিয়ে সমস্যার পেছনে রয়েছে এর চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা। এ বছর আমাদের নিজেদের দেশ থেকেই চামড়া রফতানিতে ২৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিলো। এছাড়া চামড়ার ৫০ শতাংশ রফতানি হয় চীনে। চীনের বাজারেও এখন চাহিদা নেই।

তিনি আরো বলেন, চামড়াজাত পণ্যের বাজারে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ রাখা হলেও বিষয়টি জানানো হয়েছে ঈদের মাত্র দুই-তিন দিন আগে। আবার যে, ভারতে রফতানি হবে, সেখানেও এ নিয়ে প্রচারণা চালানো হয়নি। ফলে প্রচারণার অভাবেও ঈদের সময় চামড়া রফতানির সুযোগটি কাজে লাগানো কঠিন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, গত দুই বছর ধরে যেভাবে চামড়ার দাম কমছে, এতে অনেকেই চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে আগের মতো সচেতন থাকবে না। এতে চামড়ার গুণগত মান সংগ্রহ পর্যায়েই নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া দু’দিনের ব্যবসায়ী জন্ম নেয়ার কারণে ট্যানারির মালিকরাও লাভবান হচ্ছে না। যেখানে ট্যানারির মালিক নেই বা তাদের প্রতিনিধি নেই, সেখানে অন্য একটি শ্রেণি চামড়ার মূল লাভ নিয়ে যাচ্ছে। তাই চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

সুত্রঃ ডেইলি বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *