সাদা মনের মানুষ---গাছ পাগল লেবু স্যারসাদা মনের মানুষ---গাছ পাগল লেবু স্যার

বটবৃক্ষ প্রেমিক লেবু পাগলার বটের ছায়ায় প্রশান্তির প্রাণ জুড়াচ্ছে পথচারীরা। শুধু তাই নয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসার জন্য নিজ অর্থে পাকা করে তৈরি করে দিয়েছেন বেঞ্চ। এতে পথিকের মন একটু হলেও টানে বেঞ্চে বসে সুশীতল হতে।
এসএম জুলফিকার আলী লেবু কাহেতপাড়া কেজিএস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তবে সমাজে তাকে ভালোবেসে লেবু পাগলা বলেই ডাকে। তার এ পাগলা নামটি গ্রাম থেকে শুরু করে জেলা শহরসহ পাশের টাঙ্গাইল, শেরপুরে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। ছোট থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষই তাকে চেনে-জানে।

সাদা মনের এ মানুষটি সেই কিশোর বয়স থেকে শুরু করেছেন বটগাছ লাগানো আজো চলছে। শুধু বটবৃক্ষই নয়- আম, জাম, কাঁঠাল, পেঁপে, জামরুল, আতা এছাড়াও তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ঔষধি গাছ। প্রতিদিনই তার বাড়ি থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে কবিরাজ গাছ সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে।

লেবু পাগলার ছায়াঘেরা বটগাছ দুপুরে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা তখন গ্রামের মানুষদের কাছে প্রকৃতির আশির্বাদ যেন বটবৃক্ষ। একসময় এই বটগাছই ছিল কৃষকের স্বস্তির স্থল।

শ্রান্ত পথচারী, পথিক ও পশু-পাখিদের অস্থিরতা দেখে অজোপাড়া গাঁয়ের এক কিশোরের চিত্ত্ব অস্থির হয়ে ওঠে। কিভাবে শান্তির সুশীতল ছায়া দিয়ে প্রশান্তি দেবে। ভাবতে ভাবতে তরুণের ভাবনার রাজ্যে ভেসে ওঠে রাস্তা, পান্তর, তেপান্তরে প্রাচীনকালের বিশাল আকৃতির বটবৃক্ষের কথা। যা আজ বিলুপ্তির পথে। হ্যাঁ, একমাত্র বটবৃক্ষই পারে রুক্ষ্ম প্রকৃতির তীব্র তাপদাহ থেকে প্রাণিকূলকে প্রশান্তি দিতে।

জামালপুরে এখনো এ বটছায়া মেলে। লেবু পাগলার রোপিত সহস্রাধিক বটবৃক্ষ জামালপুর জেলার পথচারীদের ছায়া দিচ্ছে পথচারীকে। গাছ নিয়েই তার যত পাগলামো। সুযোগ পেলেই গাছ লাগানো, মানুষকে ডেকে গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া, এমনকি যে কোনো উৎসবে অনুষ্ঠানে গাছ উপহার দেয়া মানুষের কাছে তাকে পাগল হিসেবে পরিচিত করিয়েছে। কেজিএস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসএম জুলফিকার আলী লেবু জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ছবিলাপুর গ্রামের বাসিন্দা। ৩৮ বছর ধরে তিনি বটগাছ লাগিয়ে চলেছেন।

তিনি জানান, গ্রামের ধর্ম সভা থেকে মাওলানার ওয়াজে বৃক্ষ রোপণ পূণ্যের কাজ কথাটি শুনে গাছ লাগানো শুরু করেন। রাস্তার দুই পাশে, বিভিন্ন গ্রামের মোড়ে ও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বটগাছ রোপণ করে যাচ্ছেন অহর্নিশ।

১৯৮২ সাল থেকে তিনি বাড়ির আশপাশসহ বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগানো শুরু করেন। বটগাছ লাগানোর প্রতি বিশেষ ঝোঁক সৃষ্টি হয় আরো কয়েক বছর পর। বাবা ছিলেন সামান্য কৃষক। কৃষিকাজের আয় দিয়ে তিন ভাই ও দুই বোনের সংসারে দু’মুঠো খেয়েপরে চলাই দুস্কর ছিল। কিন্তু এ অনটনের মধ্যেই গাছের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তৈরি হয় জুলফিকার আলীর। ভাইদের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় তিনি সংসারের বাজার-সদাই করতেন। সেই বাজারের খরচ থেকে সামান্য কিছু বাঁচিয়ে রেখে দিতেন গাছের চারা কেনার জন্য।

সরেজমিনে মেলান্দহ উপজেলার যেকোনো জায়গায় নামলে জুলফিকার আলীর লাগানো বটগাছ চোখে পড়ে। রাস্তার মোড়ে, গ্রামের পথে, স্কুল-কলেজের মাঠে বাজারে তার লাগানো গাছের পাতা বাতাসে দুলে উঠছে। শুধু মেলান্দহ উপজেলাই নয়, জামালপুর সদর উপজেলা, মাদারগঞ্জ উপজেলা ও সরিষাবাড়ি উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে তার গাছ।

রাস্তার দু’পাশে ও ফাঁকা স্থানে রোপণ করতেন গাছের চারা। শীত-গ্রীষ্ম, রোদ-বৃষ্টিতে ক্লান্তিহীন গাছ রোপণ করে যান জুলফিকার আলী। মানুষের উপহাস তাকে টলাতে পারেনি। তার লাগানো চারা গাছ এখন হাজার হাজার মানুষকে শীতল ছায়া দিচ্ছে।

জামালপুরের বিভিন্ন গ্রাম, হাটবাজার, কবরস্থান, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিভিন্ন রাস্তার মোড়, ঈদগাহ মাঠ ও সরকারি খালি জায়গায় যেখানে সুবিধা পেয়েছেন, সেখানেই গাছ লাগানো শুরু করেন তিনি। এরই মধ্যেই তিনি সহস্রাধিক বটগাছের চারা রোপণ করেছেন।

জুলফিকার আলী বলেন, বটের ছায়া শীতল। সেখানে একত্রে অনেক মানুষ বসতে পারে। তাছাড়া ফলের গাছ বড় হলে মরে যায়। কিন্তু বটগাছ মরে না। জুলফিকার আলীর ধারণা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বটগাছ খুবই প্রয়োজন। আমাদের দেশে একসময় অনেক বটগাছ ছিল। এখন তা বিলুপ্তির পথে। তাই বটগাছ লাগালে আলাদা শান্তি পাই।

তিনি আরো বলেন, জীবনে যতদিন বাঁচবো ততদিনই গাছের চারা লাগাবো।

ঘোষেরপাড়ার ইমরান হাসান বলেন, ‘লেবু স্যার তার নিজ এলাকাতে ২০০ বটগাছ লাগিয়েছেন। অনেক গাছ বড় হয়েছে। গাছের ছায়ায় মাঠে কাজ করতে আসা কৃষক শ্রমিক মজুর বটের মূলে বসে শীতল হচ্ছে।

বেলাল হোসেন বললেন, লেবু স্যার আমাদের আশার প্রতীক। তিনি একা যে পরিমাণ বটগাছ লাগিয়েছেন তার মতো দু একজন থাকলে পুরো মেলান্দহ বটগাছে ছেয়ে যেতো। মানুষ পেতো প্রশান্তি।

পথচারী জামাল উদ্দিন বলেন, ‘গাছপাগল লেবু মাস্টারকে সবাই এক নামেই চেনে। গাছ ছাড়া তিনি যেন কিছুই বোঝেন না। তার লাগানো বটগাছের কারণে এ মোড়ের নামকরণ হয়েছে বটতলা।

লেবু মাস্টার সত্যিই একজন গাছপাগল। ছোট বেলা থেকেই গাছ লাগানো তার নেশা। প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর আগে একটি বটগাছ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লাগান। এখন গাছটি অনেক বড় হয়েছে। এ গাছতলায় শিক্ষার্থী শারীরিক কসরত ও সবাই বসে বিশ্রাম নেয়ার কথা জানান সাইদ আহমেদ।

একদিন জুলফিকার আলী লেবু মাস্টার বেঁচে থাকবেন না- কিন্তু তার এ সুশীলতল বটগাছ কালের সাক্ষী হয়ে পথচারী ও পশু-পাখিকে স্বর্গীয় সুবাতাস বইয়ে দেবে যুগ যুগ ধরে।

সুত্রঃডেইলি বাংলাদেশ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *