“….এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা, এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা…,—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কৃষিবিদ জুয়েল রানা:বাঙালীর প্রাণের কবি, বাঙালীর আলোকবর্তিকা রবী ঠাকুর অবিস্মরণীয় সাহিত্য স্রষ্টা হিসাবে আমাদের কাছে প্রকাশিত। গ্রামীন জনপদের অর্থনীতির উন্নয়ন ও কৃষির আধুনিকায়নে তাঁর অসামান্য অবদান যেন কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘের মতই অপ্রকাশিত।
জমিদার পরিবারে বড় হলেও বাল্যকাল থেকেই গ্রামীন জনপদের মানুষের কাছে তাঁর আসা-যাওয়া। জমিদারদের মত ভাবনা তাঁর কোনকালেই ছিলোনা বরং দরিদ্র, ক্ষুধা জর্জরিত মানুষের জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠতো। জমিদারকে তিনি জমির জোক বা প্যারাসাইট বলে উল্লেখ করতেন। তিনি শুধু গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্যের কথাই সাহিত্যে তুলে ধরেননি, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কথাও বলেছেন। আর এসব মানুষের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে তিনি জীবনের বেশ সময় কাটিয়েছেন। কৃষিকে তিনি গ্রামীন অর্থনীতির সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ উপায় হিসাবে দেখতেন।
কবিগুরু বিশ্বাস করতেন কৃষির আধুনিকায়ন ব্যতীত গ্রামোন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই কৃষির বিভিন্ন কলা-কৌশল, সমবায় ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা, বিপণন ব্যবস্থার সংস্কার, শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষিবিজ্ঞান অন্তর্ভূক্তির গুরুত্ব, কৃষি বহুমূখীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। অবদান রেখেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই। গ্রামীন গণমানুষের মুক্তির পথে সারাজীবন তিনি কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
আজ করোনার আঘাতে সারা পৃথিবীসহ বাংলাদেশের অর্থনীতিও সমূহ চ্যলেঞ্জের মুখোমুখি। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় আজ কবিগুরুর গ্রামোন্নয়নের সেই দর্শন প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে। কারণ গ্রামীন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেই মানুষ এ যাত্রায় বেঁচে যায়। রাষ্ট্রকে তিনি বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতেন। বাংলাদেশে পতিসর ও শিলাইদহে পারিবারিক জমিদারি দেখতে এসে তিনি দেখেন গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। একদিকে ক্ষয়িষ্ণু কৃষি উৎপাদন আরেকদিনে মহাজনের ঋণের বোঝায় ক্লিষ্ট কৃষক। গ্রাম-বাংলার মেহনতি মানুষের এই দৃশ্যগুলো কবিহৃদয়কে নাড়া দেয়। পল্লী উন্নয়ন আর কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন নিয়ে ভাবনা আর কাজের শুরু তখন থেকেই। কৃষি নিয়ে করতেন ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য ট্রাক্টরের ব্যবহার শুরু করেন। নতুন জাতের ধান, আমেরিকা থেকে আনা ভূট্টা, আখ, আলু এমনকি রেশম নিয়েও শিলাইদহের বাড়িতে পরীক্ষামূলক চাষ করতেন।আমাদের জাতীয় সংগীতেও কবির কৃষিপ্রেমের বহিঃ প্রকাশ রয়েছে। …”ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কি দেখছি…” কৃষি ও গ্রামীন সমাজ-জীবনকে এক আবেগী দৃষ্টিভংগী দিয়ে দেখেছেন সারাজীবন।
১৯০৫ সালে কবি চাষিদের জন্য পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। নোবেল পুরষ্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ এই ব্যাংকে তিনি বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে এই ব্যাংক বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রুপান্তরিত হয়। কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চতর জ্ঞান লাভের জন্য পুত্র রথীন্দ্রনাথকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। দেশে ফিরে এলে কবি পুত্রকে বলেন কৃষি উন্নতির কাজে মনোনিবেশ করতে। জামাতা নগেন্দ্রনাথ ও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে ডিগ্রী লাভ করে ফিরে আসেন। পুত্র-জামাতার লব্ধ জ্ঞান আর কবিগুরুর অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে কৃষি নিয়ে চলে এক কর্মযজ্ঞ। ১৯০৯ সালে ৮০ বিঘা জমির উপর শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে স্থাপন করা হয় খামার। নতুন ফসলের উপর এখানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতো। মাটি পরীক্ষার জন্য একটি ল্যাবরেটরীও স্থাপন করেন শিলাইদহে। কৃষিতে বহুমূখীকরণের জন্য তিনি জমিতে কলা, আলু, আনারস, ফল উৎপাদনের পরামর্শ দিতেন। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য পতিসরে তিনিই প্রথম ট্রাক্টর ব্যবহার করেন। প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকের ব্যাংক ঋণ মওকুফ করে দিতেন। শিক্ষার বিস্তারে এসময় প্রচুর স্কুল নির্মান করেন। তিনি গ্রামোন্নয়নে সমবায়ের উপর বেশ জোর দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন সমবায় ব্যাংক।
১৯১২ সালে শান্তিনিকেতন সংলগ্ন গ্রামে শ্রীনিকেতন কৃষি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই কাজে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করেন একজন কৃষিবিদ, যার নাম লিওনার্ড এলমহার্স্ট। ক্ষুদ্র কৃষি ও কুটির শিল্পের বিকাশেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। বিভিন্ন গ্রামে হিতৈষি সভা গড়ে তোলেন। এই সভার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে পতিসরে গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক পাঠশালা স্থাপন করেন।
কবিগুরু রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সমবায়ভিত্তিক কৃষি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। দুই সপ্তহের সফরে রাশিয়াতে তিনি আধুনিক খামার পরিদর্শন করেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় কৃষির গুরুত্ব প্রত্যক্ষ করেন। “রাশিয়ার চিঠি”তে-এ সমর্কিত বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর সাথে কবির ছিলো নিবিড় যোগাযোগ। উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণায় যুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা। শ্রীনিকেতনের ৭০০ একর জমির মধ্যে ২০০ একর জমি সেখানকার সাওতালদের কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রদান করেন।
রবীঠাকুর ছিলেন একজন গভীর সমাজ চিন্তক। তিনি লিখেছেন, “গ্রামগুলো না বাঁচিলে বাংলা উৎসন্নে যাইবে।” তাঁকে অখন্ড ভারতের পল্লী উন্নয়নের অগ্রদূত বললে অত্যুক্তি হবেনা। পুত্র-জামাতা্র উদ্দশ্যে চিঠিতে লিখেছিলেন, “তোমরা দূর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ, ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাসের কিছু পরিমাণ ও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে মনে সান্ত্বনা পাব।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর ও রবীঠাকুরের প্রভাব ছিলো। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথকে আমি ভালোবাসি তার মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের জন্য।” জাতির পিতা বলতেন সঞ্চয়িতা সাথে থাকলে তাঁর আর কিছুই লাগেনা, বেশি ভালোবাসতেন কবিগুরুর গান ও কবিতা। আমার সোনার বাংলা গানটিকে তাঁর উদ্যোগেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
কবিগুরুর প্রার্থনা ছিলো–“বাংলার মাটি, বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পূণ্য হউক পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।” বিশ্বকবির এই প্রার্থনাকে বাস্তব রুপ দিতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
দেশ আজ মহামারিতে বিপর্যস্ত। খাদ্য নিরাপত্তা ও ব্যাপক কৃষি উৎপাদন এখন আমাদের মূল শক্তি। অর্থনীতিবিদগণ গ্রামীণ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। কবিগুরুর সমাজ দর্শন এতদিন পরে নতুন করে অনুধাবন করার সুযোগ এসেছে। তাঁর উন্নয়ন দর্শন ছড়িয়ে যাক সর্বত্র-গ্রামের শ্রমজীবি মানুষই নতুন দিনের সূচনা করুক।
=============
লেখক:বিসিএস (কৃষি)
আইপিএম স্পেশালিষ্ট, পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা
সুত্রঃ এগ্রিলাইফ